শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

টেরিবল টু: শিশুদের দুই বছর বয়স নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা এবং এর বাস্তব চিত্র

টেরিবল টু: শিশুদের দুই বছর বয়স নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা এবং এর বাস্তব চিত্র

শিশুদের দুই বছর বয়সকে অনেকেই “টেরিবল টু” বলে অভিহিত করেন। এটি এমন একটি সময় যখন শিশুরা দ্রুত শিখছে, নিজের স্বাধীনতা দাবি করছে, এবং চারপাশের জগতকে বোঝার চেষ্টা করছে। তবে, এই বয়সকে ঘিরে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। এ ব্লগে আমরা “টেরিবল টু” ধারণাটি বিশ্লেষণ করব, এর মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণগত দিক নিয়ে আলোচনা করব এবং পিতামাতা ও অভিভাবকদের জন্য কার্যকর পরামর্শ দেব।

টেরিবল টু: শিশুদের দুই বছর বয়স নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা এবং এর বাস্তব চিত্র

টেরিবল টু: ধারণার উত্থান ও পটভূমি

“টেরিবল টু” শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছে শিশুদের এই বয়সে তাদের আচরণগত চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে। ১৯৫০-এর দশক থেকে এই শব্দটি শিশুর চঞ্চলতা, আবেগের তীব্রতা, এবং নিয়মিত বিক্ষোভমূলক আচরণের বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দুই বছর বয়সে শিশুরা তাদের পরিচয় তৈরি করতে শুরু করে এবং সেইসঙ্গে তাদের স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে।

তবে, টেরিবল টু শুধুমাত্র নেতিবাচক নয়। এটি শিশুর স্বাভাবিক মানসিক ও শারীরিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি এমন একটি সময় যখন শিশুরা তাদের আবেগ, ভাষা, এবং সামাজিক দক্ষতার বিকাশ ঘটায়।

এই বয়সে শিশুর বিকাশের বৈশিষ্ট্য

১. ভাষার উন্নয়ন:

দুই বছর বয়সে শিশুর ভাষাগত দক্ষতার দ্রুত বিকাশ ঘটে। তারা দুই বা তিনটি শব্দের বাক্য গঠন শুরু করে এবং নিজস্ব মতামত প্রকাশের চেষ্টা করে।

২. স্বাধীনতার চাহিদা:

শিশুরা এই বয়সে স্বতন্ত্রতা প্রদর্শন করতে চায়। তারা নিজেরাই কাজ করতে চায়, যেমন—খাওয়া, জামাকাপড় পরা বা খেলার ক্ষেত্রে।

৩. আবেগের তীব্রতা:

শিশুরা তাদের আবেগ প্রকাশ করতে শেখে। তবে, এই সময় তারা অনেক সময় তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা রাগ, কান্নাকাটি বা বিরক্তি হিসেবে প্রকাশ পায়।

৪. সীমা নির্ধারণের চেষ্টা:

শিশুরা কখনো কখনো পিতামাতার নির্দেশনা অমান্য করতে পারে। এটি তাদের নিজস্ব ইচ্ছা এবং সীমানা চিহ্নিত করার চেষ্টার অংশ।

টেরিবল টু এর আচরণগত চ্যালেঞ্জগুলো

১. রাগের বিস্ফোরণ (Temper Tantrums):

শিশুরা কোনো কিছু না পাওয়ার কারণে বা তাদের ইচ্ছা পূরণ না হলে রেগে যায়। এই রাগ প্রকাশ পায় কান্না, চিৎকার, বা মাটিতে শুয়ে পড়ার মাধ্যমে।

২. “না” বলার প্রবণতা:

দুই বছর বয়সে শিশুরা প্রায়ই “না” শব্দটি ব্যবহার করে। এটি তাদের নিজের ইচ্ছা প্রকাশের একটি মাধ্যম।

৩. ভাগাভাগি করতে না চাওয়া:

এই বয়সে শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের জিনিসপত্র ভাগাভাগি করতে চায় না। এটি তাদের ব্যক্তিসত্তার গঠনের একটি ধাপ।

৪. বিপরীতমুখী আচরণ:

কোনো কাজ করতে বললে শিশুরা ঠিক তার উল্টো কাজ করতে পারে। এটি মূলত তাদের সীমা পরীক্ষা করার প্রচেষ্টা।

টেরিবল টু-এর ইতিবাচক দিক

যদিও অনেকেই টেরিবল টুকে নেতিবাচক হিসাবে দেখেন, এটি আসলে একটি স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর বিকাশের ধাপ।

১. আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ:

শিশুরা ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করে কীভাবে তাদের আবেগ পরিচালনা করতে হয়।

২. সমস্যা সমাধানের দক্ষতা:

শিশুরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করে।

৩. মানসিক স্থিতিশীলতা:

এই বয়সে শিশুরা নিরাপত্তার ধারণা গড়ে তোলে, যা তাদের ভবিষ্যত আচরণকে প্রভাবিত করে।

পিতামাতার জন্য কার্যকর পরামর্শ

টেরিবল টু মোকাবিলায় পিতামাতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১. ধৈর্য ধরুন:

শিশুর আচরণ স্বাভাবিক এবং সাময়িক। তাদের প্রতি ধৈর্যশীল হোন এবং বুঝার চেষ্টা করুন।

২. সীমা নির্ধারণ করুন:

শিশুদের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করুন এবং তাদের সেই নিয়মের মধ্যে পরিচালিত করতে সাহায্য করুন।

৩. বিকল্প দিন:

শিশুরা অনেক সময় স্বাধীনতা চায়। তাদের বিকল্প দিন—যেমন, “তুমি কি এই খেলনাটা চাও, না অন্যটা?”

৪. ইতিবাচক ব্যবহার পুরস্কৃত করুন:

শিশু যখন ভালো আচরণ করে, তখন তাদের প্রশংসা করুন। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।

৫. সময় দিন:

আপনার শিশুকে যথেষ্ট সময় দিন এবং তার সঙ্গে খেলুন। এটি তাদের মানসিক স্থিতিশীলতায় সহায়তা করবে।

মিথ এবং বাস্তবতা

মিথ: টেরিবল টু শুধুই একটি কঠিন সময়।

বাস্তবতা: এটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, এবং আবেগীয় বিকাশের একটি প্রয়োজনীয় ধাপ।


মিথ: শিশুরা এই বয়সে খুব “বেগারামি” করে।

বাস্তবতা: শিশুরা তাদের স্বাধীনতা প্রকাশ করার চেষ্টা করছে।


মিথ: শিশুর রাগ দেখানো মানে তারা খারাপ স্বভাবের।

বাস্তবতা: এটি তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখার প্রাথমিক ধাপ।

টেরিবল টু: শিশুদের দুই বছর বয়স নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা এবং এর বাস্তব চিত্র

শেষ কথা 

টেরিবল টু কোনও সমস্যা নয়, বরং এটি শিশুর জীবনের একটি স্বাভাবিক ধাপ। এই সময়ে পিতামাতা এবং অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া, ধৈর্যশীল থাকা এবং ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা।

টেরিবল টুকে সঠিকভাবে পরিচালনা করলে এটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে এবং একটি সুস্থ ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করবে।

তথ্যসূত্র 

1. Berk, L. E. (2013). Child Development. Pearson Education.

2. Kohn, A. (2005). Unconditional Parenting. Atria Books.

3. Siegel, D. J., & Bryson, T. P. (2012). The Whole-Brain Child. Delacorte Press.

4. American Academy of Pediatrics (AAP). (2020). "Parenting at 2 Years."

5. Harvard Center on the Developing Child. (2016). “Understanding Early Childhood Development.”

6. UNICEF. (2021). "Supporting Young Children’s Emotional Growth."

7. National Institute of Child Health and Human Development (NICHD). (2019).

8. Brazelton, T. B., & Sparrow, J. D. (2003). Touchpoints: Birth to Three.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুস্থ জীবনযাত্রার ১০টি সহজ টিপস: আজ থেকেই শুরু করুন

সুস্থ জীবনযাত্রার ১০টি সহজ টিপস: আজ থেকেই শুরু করুন সৃষ্টিকর্তার সবচাইতে বড় নিয়ামতগুলোর মধ্যে একটি হলো সুস্থতা। আমরা সবাই সুস্থ থাকতে চাই ...